শনিবার, ৭ই জুন, ২০২৫

রায়পুরে বিতর্কিত শিল্প পূণ মেলা : বাজার ব্যবসায়ীদের মাঝে চরম ক্ষোভ ! যে কোন মুহুতে আন্দোলন

রায়পুর উপজেলা প্রতিনিধি।। লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে চলছে মাসব্যাপী দেশীয় শিল্প ও পণ্য মেলা ২০২৪। গত ১৫ নভেম্বর উদ্বোধন হয় এ মেলা, চলবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে এই মেলা নিয়ে রায়পুরের ব্যবসায়ীদের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ। মেলা শুরুর পূর্বে রায়পুর বাজারের ব্যবসায়ীরা মেলা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিলেন রায়পুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর। কিন্তু উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ ইমরান খান তখন ব্যবসায়ীদের জানান- যেহেতু মন্ত্রণালয়ের দেয় অনুমোদনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক এই মেলার অনুমতি দিয়েছেন, সেহেতু মেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত দেওয়ার কোন এখতিয়ার তাঁর নেই।

ব্যবসায়ীরা বলেন, ছোট্ট একটি উপজেলা শহরে এক বছরে দু’টি মেলার আয়োজনে রায়পুর বাজারে ক্রেতা সংকট দেখা দিয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। তাছাড়া এ মেলায় যেসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে তার সবগুলোই রায়পুর বাজারে পাওয়া যায়। এভাবে মেলা চলতে থাকলে রাস্তায় বসা ছাড়া উপায় থাকবে না তাদের। ঋণের টাকা পরিশোধ, দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচ বহন করা সম্ভব হবে না। এতে করে রায়পুর বাজারের প্রায় ২০ হাজার দোকানমালিক ও কর্মচারী পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্বিষহ অবস্থায় পড়েছে।

রায়পুর বাজারের ব্যবসায়ী নেতা আলী হায়দার বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চলতি বছর ফেব্রুয়ারী মাসে রায়পুরে অনুরূপ মাসব্যাপী একটি মেলা হয়েছে। তখনও তারা ঐ মেলা বন্ধের দাবীতে জেলা প্রশাসক বরাবর দরখাস্ত করেছিলেন। কিন্তু তখন মেলার সাথে সম্পৃক্ত লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাংসদ নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন এবং রায়পুর উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের নের্তৃবৃন্দের হস্তক্ষেপের কারণে সেই মেলা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

রায়পুর বাজারের আরেক ব্যবসায়ী সেলিম পাটোয়ারী বলেন, যেসব পণ্যের দোকান বাজারে বিদ্যমান সেসব পণ্যের মেলা আয়োজন কতটা যৌক্তিক তা আমদের বোধগম্য নয়। আমাদের দোকানে কেনাকাটা করতে কোন প্রবেশ টিকেট লাগেনা, অথচ মেলায় প্রবেশের জন্য টাকা লাগে। মেলায় নিন্মমানের কয়েকটি রাইড বসিয়ে মেলা কর্তৃপক্ষ নারী ও শিশুদের আকর্ষণ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

মেলায় আগত এক নারী অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ডিসেম্বর মাস প্রাইমারী ও হাইস্কুলে ফাইনাল চলছে। এসময় মেলার আয়োজনে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটছে। পরীক্ষার মধ্যেও ছেলেমেয়েদের চাপে তাদের মেলায় নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।

ব্যাংক কর্মকর্তা ফয়সাল মাহমুদ বলেন, মেলায় পুরুষের কেনাকাটার কিছুই নেই। আর যেসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে তা নকল, ভেজাল ও খুবই নিন্মমানের।

স্কুল শিক্ষিকা নয়ন আক্তার বলেন, মেলায় প্রবেশ ফি দশ টাকা নিচ্ছে, এটা অযৌক্তিক। পাঁচ বছরের বাচ্চাদেরও টিকেট কেটে মেলায় প্রবেশ করতে হচ্ছে। তাছাড়া মেলায় রয়েছে বিনোদনের জন্য ক্ষুদ্র পরিসরের একটি বাচ্চাদের ও একটি বড়দের ইলেক্ট্রিক ট্রেন, একটি ইলেক্ট্রিক নৌকা, মানুষের হাতেটানা ছোট্ট একটি নাগরদোলা,এর পাশাপাশি রয়েছে ভুতের ঘর নামক ছোট্ট একটি অন্ধকার কক্ষ তৈরি করে তিনজন মানুষকে ভুতের পোশাক পড়িয়ে ভুত আতঙ্ক দেওয়ার প্রচেষ্টা। এসবের প্রতিটির উপভোগের জন্য প্রতি তিন মিনিট সময়ের টিকেটের মূল্য নেওয়া হচ্ছে পঞ্চাশ টাকা। যা অনেক বেশি।

গতকাল শনিবার সরেজমিন গিয়ে পুরো মেলাজুড়ে চোখে পড়ছে উৎসবের আমেজ। জানাযায়, সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত প্রতিদিনই এখানে ভিড় জমাচ্ছেন নানা বয়সী মানুষ। স্টলগুলোতে দেখা যায় উপচে পড়া ভিড়। তবে মেলায় আনা সকল পণ্যই একেবারে নিন্মমানের।

খোঁজ নিয়ে জানাযায়, দেশে গত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছর একটি সিন্ডিকেট কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায়, উপজেলায় মেলার আয়োজন করে আসছেন। মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে তারা এসব মেলার অনুমোদন নিয়ে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও পতন হয়নি এসব সিন্ডিকেটের। একটি সূত্র জানায়, মেলার আয়োজকরা যে এলাকার অনুমোদন পান তারা সেই এলাকার প্রশাসনের কর্মকর্তা, প্রভাবশালী কিছু রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দ এবং স্থানীয় কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পরিচালনা করেন মেলার কর্যক্রম। তবে মেলা থেকে আয়ের কোন অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা পড়েনা। সবই চলে যায়, মেলার আয়োজক ও সংশ্লিষ্টদের পকেটে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানাযায়, রায়পুরে চলমান মেলার আয়োজক পার্শ্ববর্তী চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার জনৈক আলম নামক এক ব্যক্তি। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর যাবৎ তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করে আসছেন।

নাম না প্রকাশের শর্তে মেলার এক কর্মচারী বলেন, রবি থেকে বৃহস্পতিবার মেলায় দৈনিক প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের আগমন ঘটে। আর শুক্র ও শনিবার প্রতিদিন নূন্যতম বিশ হাজার মানুষ মেলায় আসেন। সে হিসেবে শুধুমাত্র প্রবেশ টিকেট থেকেই আয় নূন্যতম ২০ লক্ষ টাকা। আর মেলার বিনোদনের ৫টি রাইডের জনপ্রতি ৫০টাকা টিকেটের আয়ের অর্ধেক পান রাইড কর্তৃপক্ষ বাকী অর্ধেক নেন মেলার আয়োজক। এসব থেকে একমাসে আয় হবে অনন্ত এক কোটি টাকা। তাছাড়া মেলার স্টল বরাদ্দ বাবদও আয় হয়েছে দশ লক্ষ টাকা। অথচ এসব অর্থের বিন্দু পরিমাণও পৌঁছাবেনা সরকারি কোষাগারে। তিনি আরো বলেন- এসব মেলার আয়োজকদের অন্যকোন ব্যবসা বা আয়ের মাধ্যম নেই। বছরে ২/৩টি মেলার আয়োজন করতে পারলেই যথেষ্ট, বাৎসরিক আয় দাঁড়ায় কোটি টাকার ওপর।

মেলার এক স্টলের মালিক কবীর পাটোয়ারী বলেন, সরকার পরিবর্তন হলেও বিগত সরকারের আমলে রামরাজত্বকারী মেলার আয়োজকদের কোন কিচ্ছু আসে যায়না।

মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বিগত সরকারের নিয়োগ দেওয়া অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব ধান্দাবাজদের দৌরাত্ম বন্ধে আরো বেশি বিচক্ষণতার সাথে বর্তমান সরকারকে কাজ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন সচেতন ব্যক্তিবর্গ।

Facebook
WhatsApp
Email
Pinterest
Telegram