হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া প্রতি বছর আষাঢ় মাসে ব্যাপক উৎসাহ ও ধর্মীয় শ্রদ্ধার সঙ্গে উদযাপিত হয়। এ উৎসব মূলত ভগবান জগন্নাথদেব, তাঁর ভাই বলরাম ও বোন সুভদ্রার রথে চড়ে যাত্রার স্মরণে আয়োজিত হয়। রথযাত্রার মূল ভাবনা কৃষ্ণের বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তনকেন্দ্রিক হলেও এটি এখন এক বিশাল সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক আয়োজন।
ভারতের ওড়িশা রাজ্যের পুরী শহরে জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা সর্বাধিক খ্যাতিমান ও জাঁকজমকপূর্ণ। লাখ লাখ ভক্ত এই রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন, যা সরাসরি সম্প্রচার করা হয় দেশ–বিদেশে। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে রথ টানার পাশাপাশি হয় ধর্মীয় গীত, নৃত্য ও নানা আচার–অনুষ্ঠান।
পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, শ্রীরামপুরের মাহেশ, হুগলির গুপ্তিপাড়া ও কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলেও রথযাত্রা অত্যন্ত জনপ্রিয়। মাহেশের রথযাত্রা দেশের প্রাচীনতম রথযাত্রাগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত, যার ইতিহাস প্রায় ৬০০ বছরের।
বাংলাদেশেও রথযাত্রা বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে পালিত হয়। ঢাকার ধামরাইয়ের রথযাত্রা সর্বাধিক ঐতিহাসিক ও জনআকর্ষণপূর্ণ। ধামরাইয়ে বিশাল কাঠের রথ, কীর্তন, মেলা ও নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে হাজারো ভক্তের অংশগ্রহণে উৎসবটি উদযাপিত হয়। এছাড়াও ইসকন (ISKCON) বাংলাদেশ জুড়ে রথযাত্রা আয়োজন করে থাকে, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রথযাত্রার বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে।
রথযাত্রা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে বসে রথমেলা, যেখানে থাকে হস্তশিল্প, পিঠাপুলি, খেলনা, নাগরদোলা এবং লোকজ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। পশ্চিমবঙ্গে রথযাত্রার সময় যাত্রাপালা মঞ্চস্থের রীতি এখনো বহুল প্রচলিত। এই যাত্রাপালার মাধ্যমে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলতেন, “যাত্রাপালায় লোকশিক্ষা হয়।” তিনি নিজেও স্ত্রী মা সারদা দেবী, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ রথমেলা পরিদর্শন করেছিলেন বলে জানা যায়।
ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানের পাশাপাশি রথযাত্রা আজ এক সামাজিক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। সব বয়সের, সব শ্রেণির মানুষ এই উৎসবে অংশ নিয়ে উৎসবকে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তোলে। এটি এখন কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং বাঙালি ও ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।